বজ্রপাতের সময় কী করবেন এবং কী করবেন না?

Posted on August 6, 2025 by web-CEO
bajrapat karoniyo

ভূমিকা

বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিশেষ করে বর্ষাকাল ও গ্রীষ্মকালে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়ে যায়। অনেক সময় অসচেতনতার কারণে মানুষ বিপদে পড়ে, অথচ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই লেখায় আমরা জানব বজ্রপাতের সময় কী করা উচিত এবং কী করা একেবারেই উচিত নয়।

বজ্রপাত কীভাবে ঘটে?

বজ্রপাত মূলত বিদ্যুৎ-চালিত গ্যাস কণার সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়। যখন মেঘের ভেতরে বা মেঘ থেকে মাটির দিকে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক স্রোত নির্গত হয়, তখন তা আলো ও শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটিই বজ্রপাত। বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে।

☑️ বজ্রপাতের সময় কী করবেন

১. নিরাপদ আশ্রয়ে থাকুন

বজ্রপাত শুরু হলে খোলা জায়গা, মাঠ, জলাশয় বা উঁচু স্থান থেকে সরে আসুন। দ্রুত কোনো কংক্রিট ঘরে আশ্রয় নিন।

২. ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ রাখুন

কম্পিউটার, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরের মতো যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখুন এবং ইলেকট্রিক প্লাগ খুলে ফেলুন।

৩. ফোনে কথা না বলুন (চার্জিং অবস্থায়)

ফোন চার্জে থাকা অবস্থায় কথা বলা খুব বিপজ্জনক। বজ্রপাত সরাসরি বৈদ্যুতিক তার বা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আঘাত হানতে পারে।

৪. জানালা-দরজা বন্ধ রাখুন

বজ্রপাতের সময় জানালা-দরজা বন্ধ রাখা উচিত, যেন সেখান দিয়ে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবেশ করতে না পারে।

৫. ধাতব জিনিস থেকে দূরে থাকুন

ছাতা, সাইকেল, মোটরসাইকেল, লোহার খুঁটি ইত্যাদি ধাতব বস্তু থেকে দূরে থাকুন। এগুলো বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণ হতে পারে।

❌ বজ্রপাতের সময় কী করবেন না

১. খোলা মাঠে থাকবেন না

চাষের জমি, ফুটবল মাঠ, খোলা রাস্তায় থাকলে বজ্রপাত সরাসরি আঘাত হানতে পারে। তাই এড়িয়ে চলুন।

২. ছাতা ব্যবহার করবেন না

বিশেষত ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়। বজ্রপাত এটার মাধ্যমে শরীরে আঘাত হানতে পারে।

৩. গাছের নিচে আশ্রয় নেবেন না

অনেকেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আশ্রয় নেন, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। গাছ বজ্রপাতের আঘাত গ্রহণ করতে পারে এবং এর তরঙ্গ আপনার শরীরেও প্রবাহিত হতে পারে।

৪. নদী বা জলাশয়ে গোসল করবেন না

জল বিদ্যুৎ পরিবাহিত করতে পারে। বজ্রপাত হলে নদীতে থাকলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।

৫. বাইক/সাইকেল চালাবেন না

ধাতব কাঠামোর বাইক বা সাইকেল বজ্রপাত আকর্ষণ করতে পারে। বজ্রপাতের সময় এগুলোর ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

⚠️ বজ্রপাতের পূর্বাভাস চেনার উপায়

বজ্রপাত সাধারণত কিছু প্রাকৃতিক লক্ষণ দেখেই আগাম আঁচ করা যায়। যেমন:

১. ঘন কালো মেঘ

আকাশে যদি হঠাৎ করে ঘন কালো মেঘ জমে যায় এবং চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে, তাহলে এটি বজ্রপাতের পূর্বাভাস হতে পারে।

২. গর্জনের শব্দ

দূর থেকে মেঘ গর্জনের শব্দ শোনা গেলে বুঝতে হবে বজ্রপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। যদি গর্জনের সাথে ঝলকানো বিদ্যুৎ দেখা যায়, তাহলে সতর্ক হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া ভালো।

৩. হঠাৎ বাতাসের গতি বেড়ে যাওয়া

বজ্রপাতের আগে হঠাৎ করে বাতাসের গতি অনেক বেড়ে যায় এবং মাটির ধুলা উড়তে শুরু করে। এটি বজ্রপাতের পূর্বসঙ্কেত হতে পারে।

৪. আবহাওয়ার পরিবর্তন

আচমকা তাপমাত্রা কমে যাওয়া, আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়া এবং বাতাস ভারী হয়ে উঠা বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়।

📻 গণমাধ্যমে বজ্রপাতের সতর্কতা

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম বজ্রপাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে আগেই সতর্কতা জারি করে। যেমন:

  • বাংলাদেশ টেলিভিশন (BTV) ও অন্যান্য টিভি চ্যানেল
  • এফএম রেডিও এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যম
  • মোবাইলে এসএমএস সতর্কতা (বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে)
  • Facebook Page: আবহাওয়া অধিদপ্তরের অফিসিয়াল পেইজে নিয়মিত আপডেট

👉 সরকারি ওয়েবসাইট

🌾 বজ্রপাত ও কৃষি: বাড়তি ঝুঁকি

বাংলাদেশে অনেক কৃষক জীবিকার জন্য দৈনিক মাঠে কাজ করেন। কিন্তু বজ্রপাতের কারণে তারা বিশেষ ঝুঁকিতে থাকেন, কারণ:

  • খোলা মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাত আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি।
  • কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন ধাতব কোদাল, লাঙল ইত্যাদি বিদ্যুৎ পরিবাহী হতে পারে।
  • বজ্রপাতের ভয়ে অনেক কৃষক মাঠে কাজ বন্ধ রাখতে পারেন না, ফলে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে।

প্রস্তাবিত ব্যবস্থা:

  • স্থানীয় কৃষি অফিস বা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বজ্রপাত সম্পর্কে নিয়মিত সতর্কবার্তা প্রচার করা।
  • বজ্রপাত-প্রবণ মৌসুমে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কৃষকদের জন্য জীবন বিমা চালু করা।
  • বজ্রপাত প্রতিরোধে মাঠে বা গ্রামে বজ্র নিরোধক টাওয়ার স্থাপন করা যেতে পারে।

🏫 শিশু ও শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা

স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ বা খেলার মাঠে থাকে। তাদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ খুবই জরুরি।

  • স্কুলগুলোতে বজ্রপাত বিষয়ে নিয়মিত সচেতনতামূলক ক্লাস চালু করা যেতে পারে।
  • শিক্ষার্থীদের হাতে একটি ‘বজ্রপাত নিরাপত্তা গাইডলাইন’ লিফলেট দেওয়া যেতে পারে।
  • প্রধান শিক্ষক বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকলে স্কুলের ছুটি আগেভাগে ঘোষণা করতে পারেন।

💡 দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ও পরিকল্পনা

বাংলাদেশে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক এলাকাতেই দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির অভাব আছে।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নেওয়া যেতে পারে:

  • গ্রামে বজ্রনিরোধক (Lightning Rod) স্থাপন
  • উপজেলা পর্যায়ে ট্রেনিং প্রোগ্রাম
  • স্মার্টফোনে স্থানীয় ভাষায় সতর্কবার্তা পাঠানো
  • বজ্রপাত-সংক্রান্ত মৃত্যু হলে দ্রুত ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু করা

👨‍🌾 কৃষকদের জন্য পরামর্শ

বজ্রপাতের সময় চাষাবাদের মাঠে না থাকা সবচেয়ে ভালো। তবুও যদি বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, তাহলে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন:

  • মাঠে কাজের সময় সতর্কতার জন্য আকাশের অবস্থা লক্ষ করুন।
  • মেঘ গর্জন শোনা মাত্রই কাজ বন্ধ করে নিকটস্থ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
  • জমিতে কর্মরত অন্যান্যদেরও সতর্ক করুন।

📱 কীভাবে আগাম সতর্কতা পাওয়া যাবে?

আজকাল বিভিন্ন অ্যাপ এবং সরকারি ওয়েবসাইট বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দেয়। যেমন:

  • বিডি আবহাওয়া অ্যাপ – আবহাওয়া অফিসের অফিশিয়াল অ্যাপ
  • Disaster Alert (Android/iOS) – আগাম দুর্যোগ সতর্কতা
  • আবহাওয়া অধিদপ্তর (bmd.gov.bd) – দৈনিক আপডেট

👉 বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর

📌 জরুরি ব্যবস্থা

বজ্রপাতে কেউ আহত হলে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। এর আগে CPR বা হৃদযন্ত্র চালুর জন্য হালকা চাপ প্রয়োগ করতে পারেন (যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন)। কখনোই আহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে ভয় পাবেন না — তারা বিদ্যুৎবাহী থাকেন না।

✅ উপসংহার

বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তবে কিছু সতর্কতা মানলে প্রাণহানি এড়ানো যায়। আমাদের উচিত নিজে সচেতন হওয়া এবং অন্যদেরও সচেতন করা। বজ্রপাতের সময় করণীয় ও বর্জনীয় মেনে চললে আমরা নিজেদের এবং পরিবারকে নিরাপদ রাখতে পারব।

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের শুধু বর্তমান সময়েই নয়, আগাম প্রস্তুতি ও গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। শিশু, কৃষক, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ—সবার জন্য আলাদা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার। মনে রাখবেন, বজ্রপাতের সময় সচেতনতা মানেই জীবন রক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *